পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা

মাসিক কোন রোগ নয় প্রতিটি নারীর জীবন চক্রের একটা অংশ। তাই প্রতিটির মেয়ে যাতে মাসিক বিষয়টিকে আতঙ্ক হিসেবে না দেখে স্বাভাবিকভাবে দেখতে শেখে এবং সচেতন হয়, সেজন্য পরিবারের অবদান জরুরী। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় গার্হস্থ্য বিজ্ঞান একটি অধ্যায় ছিল ঋতুস্রাব এবং এতে করণীয়, আমাদের স্কুলটির বালিকা বিদ্যালয় অর্থাৎ এখানে কোন বালকের স্থান ছিল না। আর যে শিক্ষক আমাদেরকে পড়াতেন তিনি হচ্ছেন নারী। তবুও ক্লাসে তিনি আমাদেরকে বলেছিলেন এই অধ্যায়টি বাসায় পড়ে নিও যখন এ কথাটি উনি বললেন তখন এই ক্লাস জুড়ে ফিসফাঁস মৃদু হাসির গুঞ্জন ক্লাসের পরই ছিল টিফিন পিরিয়ড। তাই সবাই মিলে আড্ডা শুরু হল। বিষয়ের ঋতুস্রাব বা মাসিক।
সবাই যার যার অভিজ্ঞতা জানালো এক বান্ধবী জানালো যে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে বিছানায় রক্ত। এ দেখে এসে আতঙ্কে উঠেছিল ওর মনে হয়েছিল দিয়ে ওর শরীর কেটে গেছে। আতঙ্কে মাকে ডেকেছিল ও কিন্তু মা যখন দেখলেন তখনই কোন স্বস্তি হলো না। বরং আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিলেন তিনি এখন বাথরুমে যাও পোশাক বদলা এবং যথারীতি তাকে এনে দিয়েছিল সুতিক কাপড়। হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দীতেও আমাদের শহরের বেশিরভাগ বাড়িতেই কাপড়ের চলছিল। তুলা ব্যবহার করতো কেউ কেউ কেবল বাজারে এসেছিল সেনোরা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছিল তাই। কিন্তু দামের কারণে খুব কম মেয়েরাই তখন তার ব্যবহার করত।
এই বান্ধবীটির মতোই অন্যদেরও একই গল্প ছিল এ সময় দেহে কি কি ধরনের পরিবর্তন ঘটে, মনে কি ধরনের পরিবর্তন হয়, এতে যে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এমন কিছু জানাননি মায়েরা, বাবা ভাই তো দূরের কথা। আর পরিবারে যেহেতু চল নেই তা দিদি বা আপারাও এড়িয়ে যেতেন ।এইসব বিষয় নিয়ে কারো সাথে কোন রকম কথা বলাই যেন নিষিদ্ধ ছিল। আমরা যখন ক্লাস রুমে বসে গল্প করছিলাম নিতান্তই নিচু গলায় তাতে যাতে অন্য মেয়েরা শুনতে না পায়। যেহেতু কাপড় ব্যবহারের চল ছিল তাই প্রায় ওই মেয়েদের স্কুল ড্রেসের রক্ত লেগে থাকতো আর সেই একফোঁটা দাগের জন্য একটা মেয়ে যে কি পরিমাণ লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যেত তা বলার অপেক্ষায় রাখেনা। আর আমাদের টয়লেটে পেট ফেলার কোন জায়গা ছিল না বা বদলানোর মতো পরিষ্কার টয়লেটে ছিল না বর্তমান অবস্থা বলতে পারবো। তবে ধরে নিচ্ছি যে অনেক স্কুলের অবস্থা এখনো ওই রকমই আছে কেননা দিনাজপুর শহরে আমাদের স্কুলটি ছিল সবচেয়ে ভালো মানের।
এখন আসা যাক নিজের কথায় বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের তিন কন্যা আমি মা আর আমার দিদি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার আর দিদির বয়স ছিল ১০ ও ১২ বছর। তাই আমাদের মাসিক হওয়ার কথা আমরা প্রথমত মাকে জানানো। দিদির মাসিক হওয়ার পর মা যা শুরু করলেন তাতে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। মায়ের কথা হলো কোন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পবিত্র জিনিসের হাত দেওয়া যাবে না, এ সময় কোন ছেলের সাথে মেশা যাবে না, সাবধানে থাকতে হবে। যে কাপড় ব্যবহার করতো তা ছাদে শুকাতে দেওয়া হতো অন্য কাপড়ের আড়ালে যেন দেখা না যায়।এসব আলোচনা হলেও মূল আলোচনা কিন্তু কখনোই হয়নি বা আশ্বস্ত করার মত কোন ব্যাপারও ঘটেনি। আমার বান্ধবীর অনেক মায়েরাই আমার মায়ের চেয়ে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তারাও মেয়েদের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতেন না।
আমরা যেভাবে কাপড় ব্যবহার করতাম তাতে কত যে অসুখ হতে পারে তা এখন ভাবলে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে শরীর। আর আমাদের মা মাসিদের দেখলেও বুঝি আমার মা আমার বান্ধবীদের মা বা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেক নারীর লড়াইয়ে টিউমার ধরা পড়েছে এবং অস্ত্র পাচার করতে হয়েছে হয়তো এটাও একটা কারণ। মাসিক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও কোনো রকম আলোচনা হয়েছে বলে মনে পড়ে না কিন্তু ফেসবুকে দারুন এ বিষয়ে সচেতনতা চোখে পড়েছে গত কয়েক বছরে। আমাদের দেশের অনেক মেয়েরা এ বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছে। এসব লেখা পড়ে জানতে পারলাম মাসিক নিয়ে কত ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে আমাদের দেশে। আর সেসব ভুলের কারণে একটি মেয়ের শারীরিক মানসিক কত ক্ষতি হতে পারে, বাবা কিংবা মা যদি একটি নির্দিষ্ট বয়সে বা মাসিক হওয়ার পর মেয়েদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করে তাহলে ব্যাপারটি কতটা স্বস্তিদায়ক হতে পারতো।
মাসিকের সময় প্রচন্ড ব্যথায় প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে অনেক মেয়েরাই তাদের ডাক্তার দেখানো হয় না কোন তার ব্যথাটা উদ ব্যাতিক্রমে নিয়ে পরিবারের কোন মাথা ব্যথাই নেই। অথচ জার্মানিতে এসে ডাক্তার দেখানোর পর জানতে পারলাম কি কি কারণে এটা হতে পারে। শরীরে তোর মনের মাত্রা এক একজনের এক এক রকম হয়ে থাকে তাই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতার ভিন্ন হতে পারে। কারো কারো মাথাব্যথা হয়, অনেকের বমি বমি লাগে। বেশিরভাগ মেয়েদের যেটা খুবই দেখা যায় সেটা হল এ সময় অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়া।। ব্যথা উপশমের কিন্তু ওষুধ আছে মাসিক হতে পারে যে সময়ে তার আগে ওষুধ খেয়ে না খেয়ে নেয়া যাতে ওই ব্যথার কষ্ট না পাই। ফেসবুকের এক ছেলের মাকে লেখা চিঠি দিয়ে আজকে লেখাটি শেষ করব।
এক মা তার ছেলেকে একটা চিঠি লিখেছেন, যেখানে খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছিলেন মেয়েদের মাসিক হলে কতটা কষ্ট হয়, সে সময় তাদের বিশ্রাম দরকার, ঠিকমতো খাওয়া দরকার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। এমনকি স্কুলে ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়লে ছেলেরা কোন মেয়ের জামার দাগ দেখলে তা নিয়ে যদি কটুক্তি করে, তবে সেটা যে ঠিক নয় সেই মা তার ছেলেকে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন তার মেয়ে বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে যেন কথা বলে, যেন সচেতনতা আর কথা বলে, বলে যে তাদের কষ্টটা সেও বোঝে কারণ তার মায়ের কষ্ট হয়। এই মায়ের মত প্রতিটি পরিবারের বাবা-মা যদি ছেলেদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে আলোচনা করেন তবে হয়তো এই বিষয়ে সচেতনতা আরও বাড়বে। মাসিক যে একটি নারীকে অন্য একটা প্রাণের জন্ম দেওয়ার জন্য তৈরি করে, এটা যে তার জন্য কোন অভিশাপ নয় বা সমাজের নিষিদ্ধ কোন আলোচনার বিষয় নয়, মেয়েরা যেন তা বুঝতে পারে এবং ছেলেদের সঙ্গে এ বিষয়ে জন্য আলোচনা করে।, যাতে ছেলেরা এ সময় মেয়েদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে।তাই পরিবারই হোক এক্ষেত্রে একটি ছেলে মেয়ের সচেতনতা সূতিকা গার।